নুপুর (ছদ্মনাম) বড্ড দস্যি স্বভাবের মেয়ে। বাবা-মায়ের বড়ই আদরের সন্তান। সারা মহল্লা মাতিয়ে রাখে । এইঘর থেকে ওইঘর যেন মনে হয় পুরো মহল্লায় তার বাড়ি। মানুষরা ও আদর করে ভীষণ। গ্রামের মানুষ তার নাম দিয়েছে ফুলকলি অনেকে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহনের দীপাবলি বলে ডাকে । সে কোন কিছু পরোয়া করে না। ঝড়-ঝঞ্ঝা সবকিছু মাড়িয়ে সবকিছু নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা। সবে মাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে পা দিয়েছে।
বুধবার স্কুল ছুটির পর দস্যিপনার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি আসে। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা তখনও কিছু মনে করতে পারে নাই নুপুর। তার মা মারিয়া ও শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ। রাতে ভাত খেয়ে মায়ের কাছ থেকে কম্বল চেয়ে নেয় নুপুর। মারিয়া বৃষ্টি বাদলের দিনে সামান্য শীত মনে করে কম্বল দেয় নুপুরকে। কিন্তু রাত যতই গভীর হচ্ছে নুপুরের আওয়াজ তত বড় হচ্ছে। রাত পেরিয়ে সকাল হলেই নুপুরের বড়সড় শরীর টা শুয়ে আছে বিছানায়, যেন একটা কচ্ছপ। মা মারিয়ার কপালে হাত, বাবা করিমের চিন্তার ভাঁজ দৃশ্যমান। যেন পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার তাদের সামনে।
চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে বাবা করিম বেরিয়ে পড়েন রিকশা নিয়ে। সারাদিন রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যায় মালিককে দুইশো টাকা দিয়ে, তার কাছে আছে তিনশো বিশ টাকা। সন্ধ্যার পর মেয়ের অবস্থা খারাপ দেখে ছুটে যান স্থানীয় ফার্মেসির ডাক্তারের কাছে।
করিমের কথা শুনে ফার্মাসির মালিক শামিম অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ সহ ডাক্তার তিনশো পঞ্চাশ টাকার ওষুধ দেন। কিন্তু তার পকেটে আছে মাত্র তিনশো বিশ টাকা। কাঁচুমাচু করলে শামিম বলে উঠে টাকা কম নাকি চাচা? করিম লজ্জা কথা বলতে গিয়ে আবার থেমে যায়। কারণ মারিয়া যাওয়ার সময় মেয়ের জন্য একটা বিস্কুট, মশুর ডাল,ডিম ও আলো নিতে বলছিল। কারণ ডিম আলু নুপুরের ভীষণ প্রিয় খাবার। মেয়ের খাবারের কথা চিন্তা করে তিন দিনের ওষুধের জায়গায় দুই দিনের ওষুধ নেন করিম মিয়া।
আসার সময় পাশের দোকান থেকে একটা এর্নাজী বিস্কুটও নিয়ে বাড়িতে যান। নুপুরের সমাজ বিজ্ঞানের স্যার কিছু দিন আগে তাদের ক্লাসে দেখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে মূল্য এবং মেয়াদ দেখতে হয়।সে এখন কৌতূহলে সবকিছুর মূল্য দেখতে চায়, খুঁজতে চেষ্টা করে পণ্যের মেয়াদ।
নুপুর বিছানায় শুয়ে থেকেই বিস্কুটের প্যাকেট দেখে খুটে খুটে পড়তে আরম্ভ করলেন। তার বাবাকে বললেন বাবা এটার দাম বিশ টাকা না?
জবাবে তিনি বললেন হ্যাঁ বিশ টাকা। নুপুর পরে ওষুধের প্যাকেট গুলো নিলেন। দাম খুঁজতে ছিল, কিন্তু বারবার খুঁজার পরও কাশের সিরাপের দাম খুঁজে পেলেও পাচ্ছিল না অন্য ওষুধের দাম। তার বাবাকে বলল মূল্য কোথায় বাবা বড়ি গুলোর? বাবা মূল্য ছাড়া তুমি কীভাবে ওষুধ কিনে এনেছো।
মেয়ের উত্তরে তিনি বলেন আরে বাবা তোমার ফার্মেসির চাচা আমার কাছে বিশ টাকা কম রেখেছে। উনি বলেছে তিনশো সত্তর টাকা আসছিল। পরে তিনশো পঞ্চাশ দিতে বলেছে। মেয়ে প্রশ্ন করল কিন্তু গায়ে কোনো মূল্য লেখা নাই কেন বাবা?
সে প্রশ্নের উত্তর নেই নুপুরের বাবার কাছে।
উত্তর কি নেই সারা বাঙলার মানুষের কাছে?
করিম মিয়ার মতো হাজারো মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। নেই কোন চিকিৎসা, নেই ওষুধের টাকা, নেই দর কষাকষি করে দাম কমানোর সুযোগ । বর্তমানে সরকারি হাসপাতাল গুলোও যেন খামার। সেখানে ও চলে চাল,ডাল পণ্যের মতো সিন্ডিকেট। যার কবলে পড়ে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এর থেকে মুক্তি কী মিলবে?
ওষুধ এমন একটা জিনিস সকল পেশার মানুষের এটি প্রয়োজন।কেউ সদিচ্ছায় ওষুধ কিনতে চায় না।
কেউবা সারাদিন এয়ার কন্ডিশন (এসি) নিচে অফিস করতে করতে ডায়াবেটিস বানিয়ে ফেলেছে, কেউ হয়ত সারাদিন রিকশা প্যাডেল চাপতে চাপতে হাঁটুতে ব্যথা বানিয়ে ফেলেছে। দিনশেষে সবাই যাচ্ছে ফার্মেসিতে। অসুখ সারতে ওষুধ আনতে। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সচিব, এমপি এবং মন্ত্রীদের মধ্য থেকে কেউবা মুখে বলছে, কেউবা বড় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে যাচ্ছে, কেউবা মোবাইলের ছবি নিয়ে যাচ্ছে প্রেসক্রিপশনের। ভাই বা চাচা এই ওষুধ গুলো দেন। আচ্ছা ভাই দাম কত হলো।
– ও আচ্ছা মনে মনে ভাবে ওই দোকানে তো একশ টাকা বেশি বলেছিল আচ্ছা এখান থেকেই নিয়ে নেই। এই সময়েও এসে ওষুধের গায়ের মূল্য না দেখে ওষুধের মূল্য প্রদান করতে হচ্ছে তা খুবই হতাশাজনক। গায়ে কোন মূল্য লেখা থাকে না, যে মূল্য থাকে সেটা বক্সের গায়ে লেখা থাকে। সাধারণত ওই বক্স খুলে একজন বিক্রেতা ক্রেতার কাছে দিতে চায় না যে ভাই নেন দাম দেখেন। এবং একজন ক্রেতাও সেই সুযোগ পায় না দর কষাকষি করে বা মূল্য দেখে ঔষধ কিনতে। সেই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা জনসাধারণের কাছে থেকে ইচ্ছা মত দাম নিয়ে নেয়। সিলেট নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় সন্তোষ নামে একজন ঔষধ বিক্রেতার সাথে এ বিষয়ে কথা হয়।
সন্তোষ জানায়, ভারতীয় যে-সব কোম্পানি আছে সেগুলোর গায়ে মূল্য লিখা থাকে, কিন্তু দেশের কোন কোম্পানির ওষুধের গায়ে মূল্য লেখা থাকে না। যার ফলে একজন অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছা করলেই সে নিজের ইচ্ছা মত দাম বাড়িয়ে ঔষধ বিক্রি করতে পারে। তিনি আরও বলেন যেহেতু ঔষধের বক্স বা বক্সের গায়ের মূল্য একজন ক্রেতার কাছে সহজে দেখানো যায় না বা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার সে সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অসৎ পথ অবলম্বন করতে পারে। তিনি ওষুধের গায়ের মূল্য নির্ধারণ করার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
সিলেট নগরীর রিকাবি বাজার এলাকায় বসবাস করে ইন্টার পড়ুয়া সাকিব।
পরিবারের ওষুধ কিনতে আসেন স্থানীয় ফার্মাসিতে। দুঃখ প্রকাশ করে সাকিব জানায়, অন্য যে কোন প্রোডাক্ট এর গায়ে মূল্য লেখা থাকে আমরা দর কষাকষি করে জিনিস কিনতে পারি। কিন্তু ঔষধ! সিন্ডিকেটের কারণে ওষুধের দাম এখন আকাশচুম্বী। সরকারের কাছে অনুরোধ মানুষের মৌলিক অধিকার গুলো সহজলভ্য করুন। দেশের ওষুধ ব্যাবস্থপনায় শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন। ওষুধের গায়ে দাম লিখুন|
লেখক : আদিব হাসান পান্ত, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট