Top 5 This Week

চিরঘুমে ‘শেষ ঠিকানার কারিগর’ মনু মিয়া

বিডিটাইম ডেস্ক

বিনা পারিশ্রমিকে ৪৯ বছর ধরে তিন হাজারেরও বেশি কবর খুঁড়া মো. মনু মিয়া (৬৭) আর নেই। তিনি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা । শনিবার(২৮জুন) সেই মানুষটিই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন—সেই কবরস্থানে, যেখানে এক সময় তিনি নিজ হাতে তৈরি করতেন অন্যের শেষ আশ্রয়।

শনিবার (২৮ জুন) বাদ আসর জানাজা শেষে তাঁকে আলগাপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী ছিল কবর খননের দৃশ্যটি—এলাকার যাঁরা এক সময় তাঁর সঙ্গে কবর খুঁড়েছেন, তাঁরাই আজ খুঁড়েছেন মনু মিয়ার নিজের কবর।

কবর খননে নেতৃত্ব দেন জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের করণশী গ্রামের কৃষক হবু রহমান (৬০)। সঙ্গে ছিলেন টুক্কু মিয়া (৫৫), ইয়াছিন মিয়া (৫০), বাতেন মিয়া (৫০) এবং আলগাপাড়ার তরুণ মারুফ খান সুজাত (২৯)। তারা বলেন, “এটা শুধু দায়িত্ব নয়, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কাজ। আমাদের গর্ব, আমরা তাঁকে বিদায় জানাতে পেরেছি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদায়।”

মনু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ছয় দিন আগে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে তাঁকে বাড়ি আনা হয়। শনিবার সকাল ১০টায় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

জীবদ্দশায় মানুষের শেষ বিদায়ের সঙ্গী হতে কখনো কার্পণ্য করেননি মনু মিয়া। আশপাশের গ্রাম থেকে ডাক পড়লেই ছুটে যেতেন কবর খুঁড়তে। এক সময় নিজের দোকান বিক্রি করে কিনেছিলেন একটি ঘোড়া—যাতে দ্রুত মৃতের বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন। সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে জীবনের শত শত যাত্রা করেছিলেন তিনি, শুধুই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

কিন্তু জীবনের শেষ অধ্যায়টি ছিল বেদনার। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় দুর্বৃত্তরা তাঁর বহু বছরের সঙ্গী, সেই প্রিয় ঘোড়াটিকে হত্যা করে। এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মনু মিয়া।

স্থানীয় আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ মো. রোকন রেজা বলেন, “কবর খুঁড়ে তাঁকে দাফন করাটা আমাদের জন্য গৌরবময় দায়িত্ব। এটি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা নয়—ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং দায়িত্ববোধের প্রকাশ।”

মনু মিয়ার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গ্রামের মানুষ বলছেন, এখন আর এমন পরোপকারী মানুষ দেখা যায় না। বিনা পারিশ্রমিকে এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন কাজ—এটি কেবল একজন মানবিক মানুষই পারেন।

আলগাপাড়ার এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “মনু মিয়া ছিলেন আমাদের নির্ভরতার জায়গা। কেউ মারা গেলে প্রথমেই তাঁর কথা মনে পড়ত। তিনি কখনো ‘না’ বলেননি।”

তরুণদের চোখেও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। মারুফ খান সুজাত বলেন, “আমরা অনেকেই তাঁর সঙ্গে একাধিক কবর খুঁড়েছি। আজ তাঁরটাই খুঁড়লাম—হৃদয়ে কষ্ট আছে, কিন্তু গর্বও আছে।”

মনু মিয়া শুধু কবর খুঁড়েননি, তিনি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন—নীরবে, নিঃস্বার্থভাবে, ভালোবাসা দিয়ে। আজ তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন সেই মাটির নিচে, যাকে তিনি সারাজীবন সম্মানের চোখে দেখেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Popular Articles

en_USEnglish