চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জেরিন আক্তার, জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম ও জন্মতারিখে ভুল থাকায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে পড়েন জটিলতায়।
সংশোধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা মেনে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়ে আট মাসে অন্তত ১৫ বার দৌড়ঝাঁপ করেও ফল মেলেনি। শেষমেশ ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে দালালের মাধ্যমেই হাতে পান সংশোধিত এনআইডি।
জেরিনের অভিজ্ঞতা চট্টগ্রামের নির্বাচনী কার্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির এক চিত্র মাত্র। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৫ উপজেলার প্রায় প্রতিটি নির্বাচন অফিসে সক্রিয় চার-পাঁচজন দালাল নিয়মিত ঘুরে বেড়ান। তাদের পেছনে রয়েছে স্থানীয় কিছু কম্পিউটার দোকান মালিক ও নির্বাচন কমিশনের ভেতরের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদ।
কর্ণেলহাটের বাসিন্দা শিমুল কুমার বাবার নামের ‘ম’–এর স্থলে ‘শ’ সংশোধন করাতে গিয়ে ভোগেন চরম ভোগান্তিতে। যৌক্তিক কাগজপত্র দিয়েও সংশোধন হয় না বরং ঘুষের প্রস্তাব পান নির্বাচন কর্মকর্তার কাছ থেকে। তিনি বলেন,“৫০ হাজার টাকা দিলে তিন দিনের মধ্যে এনআইডি হয়ে যাবে—এমন প্রস্তাব দালালের কাছ থেকে পেয়েছি। লিখিত অভিযোগও দিয়েছি।”
তার মতো আরও অনেক সেবাপ্রত্যাশী নির্বাচন অফিসে এসে হয়রানি ও ঘুষ দাবির শিকার হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, এনআইডি সংশোধনের নামে নির্বাচন কর্মকর্তারা দালালের মাধ্যমে ৫০-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করছেন।
চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও লেনদেনের তথ্য পেয়েছি। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রক্রিয়া চলছে।”
আরেক দুদক কর্মকর্তা বলেন,“প্রধান অফিসের (ঢাকা) লোকজনও এতে জড়িত। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ ছাড়া এই দুর্নীতি সম্ভব নয়।”
চট্টগ্রামের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. বশির আহমেদ বলেন,“দায়িত্ব নেওয়ার সময় ৩২ হাজার সংশোধনীর আবেদন ছিল। জানুয়ারি থেকে চেষ্টা করছি কমাতে। তবে সত্যি বলতে দালাল ছিল, আছে, কিছু ভেতরের লোক জড়িত।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে ৩০ জুনের মধ্যে সব সংশোধনী নিষ্পত্তির ইসি নির্দেশনার পর কাজের গতি বেড়েছে। দুই সপ্তাহে অনিষ্পন্ন আবেদন ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে।
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয় জানায়, গত ডিসেম্বর থেকে চার ক্যাটাগরির প্রায় ৫৩ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। এর মধ্যে গত ৬ মাসে সাড়ে ৪৫ হাজার এনআইডি সংশোধন করা হয়েছে। সরকারি ছুটির দিনেও চলেছে এ কাজ।
তবে দালাল ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে সরাসরি কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে দিতে রাজি হননি।
চট্টগ্রামের এনআইডি সংশোধন কার্যক্রম এখন সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুটি কয়েক সৎ কর্মকর্তা সক্রিয় থাকলেও, দালাল সিন্ডিকেট আর ঘুষ বাণিজ্য মিলিয়ে এখন এই সেবার জন্য মানুষকে দিতে হচ্ছে অসহনীয় মূল্য।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এই দুর্নীতি রোধে জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের শক্ত পদক্ষেপ, প্রযুক্তি-নির্ভর ট্র্যাকিং ব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত মনিটরিং ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।