Top 5 This Week

রাস্তাহীন চরে ঘোড়ার গাড়িতেই জীবনের গতি

Spread the love

আবদুস সবুর, বগুড়া

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে আধুনিক যানবাহনের ছোঁয়া এখনও পৌঁছায়নি। যমুনা নদীর বিশাল বালুচরে বসবাসকারী হাজারো মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে ঘোড়ার গাড়ি।

রাস্তা-ঘাট না থাকায় উঁচু-নিচু বালুচর পেরিয়ে কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহণ পর্যন্ত সবই এখন এ বাহনের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশবান্ধব এই যানটির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়েছে স্থানীয় বেকার যুবকদের জন্য।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চালুয়াবাড়ি, কাজলা, কর্ণিবাড়ি, বোহাইল ও হাটশেরপুর ইউনিয়নের প্রায় ১১০টি চরে প্রায় ৫০০ ঘোড়ার গাড়ি প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কৃষিপণ্য ও যাত্রী পরিবহনে ব্যস্ত সময় পার করছে। বর্ষায় যখন চরাঞ্চল প্লাবিত হয়, তখন নৌকাই ভরসা হলেও, শুষ্ক মৌসুমে ঘোড়ার গাড়িই হয়ে ওঠে চরবাসীর একমাত্র ভরসা।

বানিয়াপাড়া চরের ৪০ বছর বয়সী ঘোড়ার গাড়িচালক ওয়াসের আলি জানান, “দৈনিক ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় এই গাড়ি চালিয়ে। ঘোড়ার খাবার ছাড়া বাড়তি খরচ নেই বললেই চলে। নিয়মিত খাবার পেলে ঘোড়াগুলো কয়েক বছর পর্যন্ত গাড়ি টানতে পারে।”

ঘোড়ার প্রিয় খাবারের তালিকায় রয়েছে ধানের কুঁড়া, সরিষার খৈল, ছোলা, খেসারি, কালাই, ভুসি ও চালের খুদ। এসব খাবার সুলভ হওয়ায় ঘোড়া পালনও তুলনামূলকভাবে সহজ।

চরের কৃষক রহমান বলেন, “চরে বাদাম, ভুট্টা, ডাল, কাউন, বোরো ধান, মিষ্টি আলু ইত্যাদি ফসল চাষ করি। কিন্তু বালুপথ হওয়ায় এসব ফসল হাটে নিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই ঘোড়ার গাড়িই আমাদের একমাত্র ভরসা।”

স্থানীয় কাঠমিস্ত্রিরা মিনিবাসের পুরোনো রিং, টায়ার ও টিউব ব্যবহার করে তৈরি করেন এসব গাড়ি। প্রতিটি গাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে ৬০-৭০ হাজার টাকা। একটি গাড়িতে প্রায় ২৭ মণ মালামাল বা ১২-১৪ জন যাত্রী বহন করা সম্ভব।

হাসনাপাড়া গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী খোকা মিয়া দীর্ঘদিন ধরে ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “প্রতিদিন তিন-চারটি খেপে প্রায় দুই হাজার টাকা আয় করি। এই আয়েই চলে পরিবারের খরচ।”

কয়েক বছর আগেও চরাঞ্চলে গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো। কিন্তু গরুর গাড়ির তুলনায় কম দামে এবং বেশি মাল টানার সক্ষমতার কারণে ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা বেড়েছে। স্থানীয়দের মতে, সুস্থ-সবল ঘোড়া দিয়ে একটি গাড়ি ১৫ থেকে ২০ মণ পর্যন্ত মালামাল অনায়াসে টানতে পারে।

সোনাতলা উপজেলার তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, “শতাধিক ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে এখানে। শুকনো মৌসুমে এটাই চরবাসীর একমাত্র যাতায়াত ও পরিবহণ মাধ্যম। বর্ষায় তারা নৌকার ওপর নির্ভর করে।”

সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন জানান, “সোনাতলার বিশাল এলাকা চরাঞ্চল হওয়ায় এখানে ফসল চাষ হয় প্রচুর। কিন্তু বর্ষা শেষে শুষ্ক মৌসুমে পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়িই ভরসা। কম খরচে সহজে পণ্য পরিবহনের উপযোগী হওয়ায় এ বাহন দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।”

কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন দিপন প্রামাণিক বলেন, “আমার ইউনিয়নের নান্দিনাচর, ডাকাতমারাচর, ইন্দুরমারাচর ও পূর্ব শনপোচাচরে নিয়মিতভাবে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়ি। রাস্তাঘাট না থাকায় চালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এক চর থেকে অন্য চর ছুটে বেড়াচ্ছেন।” যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া পৌঁছায়নি, সেখানে যমুনার চরে ঘোড়ার গাড়িই যেন সময়ের পরীক্ষিত বাহন হয়ে রয়ে গেছে। শুধু চলাচলই নয়, এই বাহন এখন চরবাসীর জীবিকার অংশও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Popular Articles

en_USEnglish